নারী নির্যাতন বন্ধে ইসলামি আইন ও আফগানের তালিবানের আমির

নারী নির্যাতন বন্ধে ইসলামি আইন ও তালেবানের ইতিহাস 

গ্রীষ্মকাল, 

একটি গ্রামের পাশ দিয়ে দুজন আরোহী মোটর সাইকেলে করে ছুটে চলেছেন ।

গ্রামে যেন উৎসবের আমেজ , বিয়ের সাজে সেজে উঠেছে পুরো গ্রাম । বরযাত্রীদের দল বিয়ে করে ছুটে চলেছে হাইওয়ে ধরে । পথিমধ্যে ডাকাতদলের খপ্পরে পড়ল, হতাহতের ঘটনা ঘটল, মহিলাদের উঠিয়ে নেয়া হল অপহরণ আর ধর্ষণের জন্য। এই ঘটনা যেন নিত্যদিনের , শুধু সেই গ্রামের নয় । পুরো দেশ যেন খুন ,ধর্ষণ আর অপহরনের সম্রাজ্য ।


স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের গণ্ডারের চামড়ায় সাধারণত ময়না তদন্তের আগে অনুভূতি হয় না। মোটর সাইকেল আরোহী মাদ্রাসার সেই মোল্লা এই ঘটনায় শুনে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলেন । 


তিনি কিছু মাদ্রাসা ছাত্র কে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন । কিছু মহিলাদের উদ্ধার করা সম্ভব হলো, আবার অনেকে ইতোমধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন। গ্রামের এই অবস্থা দেখে যে প্রশাসন নির্বিকার ছিল, তাদের বসিয়ে রাখার মানে হয় না । বিদায় করা হলো তাদের । 


শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সাথে তারা স্বেচ্ছায় তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব তুলে দিল মোটর সাইকেল আরোহী সেই কাছে । যিনি সবার আগে এগিয়ে গিয়েছিলেন চোর আর ডাকাতদলের হাত থেকে মুসলিম নারীদের ইজ্জত রক্ষা করার ডাকে সাড়া দিয়ে। 


এভাবে শুধু সেই গ্রাম নয় প্রায় পুরো দেশ শান্তি আর নিতাপত্বা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন ।


জ্বি না আমরা কোন রূপকথার সুপার হিরো কিংবা বলিউডের কোন মুভির ব্যাপারে বলছিলা । আমরা বলছিলাম , আফগানে জন্ম নেয়া খুব সাধারণ একজন মোল্লার । যার নাম ছিল মোল্লা মুহাম্মদ ওমর (রাহি)।যিনি পরিচিত ছিলেন বিশ্বাসীদের আমীর অর্থাৎ আমিরুল মুমিনীন মোল্লা উমার নামে । আর তিনি এই কাজের জন্য বাহিনী গঠন করেছিলেন তাঁর ছিল ত্বলিবান ।

স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, একা এভাবে এগিয়ে যাবার শক্তি তিনি কোথায় পেলেন? কিভাবে তিনি বাকি লোকদেরকেও সাহসী অগ্রযাত্রার সাথী করে নিলেন? আসুন শুনি তাঁর নিজের জবানীতে,


“তখন আমি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করি, মাদ্রাসাটি ছিল “সানজ সার” শহরে, কান্দাহারে। আমার সাথে আরও প্রায় ২০ জনের মত সহপাঠী ছিল। এরপর দেশে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ল, খুন হত্যা, লুটতরাজ, ডাকাতি এগুলো সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল, আর দেশের নিয়ন্ত্রণ ছিল দুর্নীতিবাজ, বাজে সমাজপতিদের হাতে। ‘এই সমাজের অবস্থার উন্নতি ঘটবে, আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে’ ; সবচেয়ে আশাবাদী লোকেরাও এমন আশা করা ছেড়ে দিয়েছিল। এমনকি আমি নিজেও তাদের মতই ভাবছিলাম, এরপর নিজেকেই বললাম, “আল্লাহ তায়ালা কখনো কাউকেই তার শক্তি সামর্থের বাইরে কোনো কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না” (বাকারাহ ২৮৬) ,


এরপর আমাকে অনুপ্রাণিত করার জন্য এই আয়াতটিই যথেষ্ট মনে হল, নইলে আমি হয়তো এই বিষয়গুলো ছেড়ে দিতাম, কারণ কোন কিছুই আমার সামর্থ্যের মধ্যে ছিল না। কিন্তু আমি আল্লাহর উপর ভরসা করলাম, খাঁটি ভরসা, আর যেকেউ আল্লাহর উপর এ ধরণের তাওয়াক্কুল করে, তার আশা কখনো হতাশায় পরিণত হয় না।


মানুষ হয়তো ভাবতে পারেঃ কখন এই আন্দোলন শুরু হল? কারা এর পিছনে ছিল? অর্থায়ন কারা করল? পরিচালনা করল কারা আর নিয়ন্ত্রণ করল কারা?


আমি তাদের বলবো, এই আন্দোলন তো শুরু হয়েছে সেদিন, যেদিন আমি আমার মাদ্রাসাতে বইটি ভাঁজ করে রেখে দিলাম, আমি আমার সাথে আরেকজন ভাইকে নিয়েছিলাম, এরপর আমরা দুজনে মিলে পায়ে হেঁটে যানযাওয়াত এলাকার দিকে গেলাম। 


এরপর সেখান থেকে আমি একটি মোটরসাইকেল ভাড়া নিলাম, যে আমাকে ভাড়া দিয়েছিলেন তার নাম ছিল ‘শুরুর’, এরপর আমরা তালুকান এলাকায় গেলাম। আর, এভাবেই আমাদের আন্দোলন শুরু হল, আপনাদের মনে যদি অন্য কোন চিন্তা উঁকি দিয়ে থাকে তাহলে সেগুলো ঝেড়ে ফেলুন !


এরপর আমরা এক মাদ্রাসা থেকে আরেক মাদ্রাসার ছাত্রদের সাথে দেখা সাক্ষাত শুরু করলাম, ছাত্রদের যে সকল হালাকা (স্টাডি সার্কেল) ছিল সেগুলোতে যেতাম, একদিনের ঘটনা, সেদিন সকাল বেলায় আমরা একটি স্টাডি সার্কেলে যাওয়ার পর দেখলাম সেখানে ১৪ জনের মতন ছাত্র অবস্থান করছএরপর আমি তাদেরকে একত্রিত করলাম আমার চারপাশে, আর বললাম, “আল্লাহর দীন এখন মানুষের পায়ের নিচে, মানুষ প্রকাশ্যে বেহায়াপনা, অশ্লীলতা করছে, খারাপ কাজ করছে, আর অপরদিকে যারা দীন মেনে চলার চেষ্টা করছে তারা তাদের দীনকে গোপন করে আছে, আর অসৎ লোকেরা পুরো এলাকায় নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে আছে, তারা মানুষের সম্পদ চুরি করে, রাস্তায় তারা মানুষের ইজ্জত হানি করে, খুন করে, এমনকি যদি কারো মরা লাশ রাস্তার উপর পড়েও থাকে, তাহলে মানুষ নির্বিকার চিত্তে তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায়, গাড়ি চালিয়ে চলে যায় আর দেখে রাস্তার উপর একটা মরা পড়ে আছে, এমনকি কোন লোক যে এসে লাশটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে দাফন করবে তাও খুঁজে পাওয়া যায় না”।


আমি তাদেরকে আরও বললাম, “এই রকম জরুরী অবস্থার মধ্যে শুধুমাত্র পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকা সম্ভব না, চালিয়ে যাওয়াও সম্ভব না, আর এই সমস্যাগুলো স্লোগান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব না, যার পিছনে কোন সমর্থন নেই। আমরা, তালেবে ইলম (ইলমের ছাত্ররা), এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াতে চাই। 


যদি তোমরাও সত্যি সত্যি চাও আল্লাহর দীনের জন্য কাজ করতে, তাহলে আমাদের পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ততা থেকে অবসর নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আর আমি তোমাদেরকে খুলে বলছি, একটা মানুষও আমাদেরকে একটা পয়সা দিয়ে সাহায্য করার ওয়াদা করেনি, তাই তোমাদের এরকম মনে করার কোন কারণ নেই, আমরা আল্লাহর দীনের জন্য কাজ করব আর বিনিময়ে অন্য কেঊ আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিবে। 


বরং, মানুষের কাছ থেকেই অনুরোধ করে আমাদের নিজেদের খাদ্য ও সাহায্য চেয়ে নিতে হবে”। আমি বলেছিলাম, “এটা একদিনের কাজ নয়, এক সপ্তাহ , এক মাস কিংবা এক বছরের কাজও নয়, বরং এতে অনেক দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। তোমরা কি সেটা করতে তৈরি আছ নাকি না ?


“গ্রীষ্মের সেই দিনগুলো ছিল খুব গরমের, মনে হতো যেন কালো রঙয়ের কেটলীতে কেউ পানি গরম করছে , আর আমি তাদেরকে উৎসাহিত করতে লাগলাম আর বলেছিলাম, ‘আজ এই রকম পরিস্থিতিতে তোমরা নিজ নিজ কেন্দ্রে বসে থাকতেই বেশি পছন্দ করছো ! অথচ তারা সরাসরি আল্লাহর দীনের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, আর আমরা কিনা দাবী করছি আমরা আল্লাহর দীনের লোক! শরীয়াহর ছাত্র, অথচ আমরা শরীয়াহর সমর্থনে কোন কাজ করছি না” !



তাদেরকে আমি বললাম, “আমরা যদি কোন একটি এলাকা জয় করতে পারি, তাহলে সেটি রক্ষা করব, আর সেই অবস্থায় কেউ এ ধরণের কথা বলো না, হায় এখন কোন পড়ার ব্যবস্থা নেই, টাকা পয়সার অভাব, অস্ত্র নেই…; কাজেই তোমরা বলো তোমরা কি এই কাজগুলো করতে তৈরি আছো ?”


এরপর সেই চৌদ্দ জনের মাঝে একজনও খুঁজে পাওয়া গেল না, যে এই সকল কাজ করতে তৈরি আছে, তারা বলল, ‘জুমার দিনে হয়তো আমরা এই কাজগুলোর কিছু কিছু কাজ করতে পারি’, উত্তর শুনে আমি বললাম, “তাহলে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে কে এই কাজগুলো করবে?”
.
আমি আল্লাহকে আমার সাক্ষী মেনে বলছি, এটাই ছিল বাস্তবতা, আর আমি যাবতীয় ইজ্জতের মালিক আল্লাহর সামনে শেষ বিচারের দিনে এই ঘটনার সাক্ষ্য দিব।

আমাদের এই আন্দোলন ছিল আল্লাহর উপর খাঁটি তাওয়াক্কুলের একটি ফলাফল, কেননা সেদিন যদি আমি ঐ কয়েকজন ছাত্রের উপর ধারণা করে বাকি মাদ্রাসা, স্টাডি সার্কেলের প্রতিও একই রকম ধারণা করে বসে থাকতাম, তাহলে হয়তো আমি নিজেও আমার পড়ালেখায় মন দিতাম, মাদ্রাসায় ফেরত যেতাম। কিন্তু আমি আমার নিজের উপর আল্লাহর জন্যে যে শপথ করেছিলাম তা পূর্ণ করার দিকে মন দিলাম, আমি যে শপথ নিয়েছিলাম তা পূর্ণ করেছি, আর আল্লাহও আমাকে সেইভাবেই চালিত করেছেন যেমনটা আজকে আপনারা দেখছেন। এরপর আমি আরেকটি পাঠশালাতে গেলাম, সেখানে প্রায় সতের জন ছাত্র ছিল, তো আমি তাদেরকে বিষয়টা উপস্থাপন করলাম যেভাবে প্রথম হালাকাতে আমি উপস্থাপন করেছিলাম (যারা ছিল তালেবে ইলম বা ইলমের ছাত্র তথা মাদ্রাসার ছাত্র), এবারে এই হালাকার সতের জনের সবাইকেই পাওয়া গেল যারা আমাদের প্রস্তাবে আল্লাহর দীনের জন্য কাজ করতে রাজী ছিল।
.
তারা প্রত্যেকেই ছিল যেন একটি জাতি সমতূল্য, তাদের মাঝে যুবক-বৃদ্ধ কোন পার্থক্য ছিল না, শিশু কিংবা যুবক, আর না নারী না পুরুষের উপর ভিত্তি করে কোন পার্থক্য ছিল, বরং এই (আল্লাহর দীনের) কাজটি ছিল আল্লাহ আমাদের যে ইলম জ্ঞান দান করেছেন তার উপর। তাই এ কাজের শুরু থেকেই আমাকে একের পর এক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে।এরপর আমরা যে একটি মোটর সাইকেল ভাড়া করেছিলাম, সেটিতে চড়ে একের পর এক মাদ্রাসা, স্কুল ও স্টাডি সার্কেলে ভ্রমণ করতে লাগলাম আসরের সালাতের সময় হওয়া পর্যন্ত । আর সে সময় দেখা গেল তিপ্পান্ন জন লোক আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা করে কাজের জন্য তৈরি আছে। এরপর আমি আমার মাদ্রাসায় ফেরত আসলাম আর তাদেরকে বললাম, “আগামীকাল সকালে এসো”, কিন্তু তারা রাতের বেলায় সবাই একসাথে সানয সার’এ এসে হাজির হল, আর এটাই ছিল শুরু।
.
আমাদের আইডিয়ার বয়স চব্বিশ ঘণ্টা পার হবার আগেই আমাদের কাজ শুরু হয়ে গেল। আর আমার একজন বন্ধু তাদের সালাতে ইমামতি করল, ফযরের সালাতে ইমামতি করার পর সেখানে উপস্থিত একজন বলল, “আজকে রাতে আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম, আমি দেখলাম ফেরেশতারা সানয সার’এ প্রবেশ করছে, আর কি কোমল ছিল তাদের হাতের পরশ, তাই আমি তাদেরকে অনুরোধ করলাম যেন তারা আমার মুখমণ্ডলে বরকতের জন্য মাসেহ করে দেয়”।


সকাল দশটার দিকে, আমরা ‘আল-হাজ বিশর’ থেকে দুটা গাড়ি চেয়ে নিলাম, তিনি একজন এলাকার ব্যবসায়ী, তিনি আমাদেরকে দুটি গাড়ি দিলেন, একটা ছোট কার, আরেকটা বড় কার্গো ট্রাক। এরপর আমরা সব ছাত্রদের “কাশক নুখুদ” এলাকার দিকে সরিয়ে নিলাম, এরপর বাদবাকি অন্যান্যরাও আমাদের সাথে যোগ দিল। আর যখন একসাথে অনেক লোক জমায়েত হল, আমরা লোকদের কাছ থেকে অস্ত্র ধার করলাম, আর এভাবেই শুরু হয়েছিল আমাদের প্রতিরোধ আন্দোলন, যেভাবে আজকে পর্যন্ত তা চলে আসছে…” ।
.
হ্যাঁ অতান্ত আশ্চয্যজনক হলেও , সত্যি এভাবেই জন্ম হয়েছিল তালিবানের । কয়েকজন বোনের সম্ভভ বাচাতে গিয়ে তারা এমন এক ইতিহাস তৈরি করল , যা ইতিহাসে স্থান করে নিল ।তারা ধীরে ধীরে আফগানের বেশীর ভাগ ভূমি দখল করে নিতে শুরু করল । যেখানেই তারা দখল করত তারা সেখানে শরিয়াহ আইন প্রনোয়ন করতে লাগল । দুর্নীতি, পতিতালয়, সিনেমা, গান-বাজনা, অশ্লীল ভিডিও ইত্যাদি ধ্বংস করে দিতে লাগল । 


নারীদের নিরাপত্বা নিশ্চিত করল । শরিয়ার আইনকে কঠোর ভাবে প্রয়োগ করা হলো ।যেসব জায়গায় নারীদের অবস্থান জায়েজ না তা থেকে তাঁদের মর্যাদার সাথে অপসরণ করা হলো । পর্দার বিধানকে নিশ্চিত করা হলো । এভাবেই ইতিহাস প্রত্যক্ষ করলে এক নতুন যুগের ,এক নতুন আন্দোলোনের , এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী নেতার । যেই ত্বলিবানের সৃষ্টি হয়েছিল নারীদের সম্মান রক্ষার জন্য , শান্তি আর নিরাপত্বা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদের কে উপাধী দেয়া হলো নারী নির্যাতন কারী ,অসভ্য বর্বর , জঙ্গি ,সন্ত্রাসী ।

- Topu Ahmed 

Next Post Previous Post