বাংলা গল্প "একদিন " লেখক ইমরান রাইহান | বাংলা ছোট গল্প অনলাইন

বাংলা গল্প "একদিন" লেখক ইমরান রাইহান

বাংলা গল্প "একদিন" লেখক ইমরান রাইহান
  
নোমানের সাথে দেখা হলো কয়েক মাস পর। মনে হলো, অনেক বছর কেটে গেছে। মাদরাসাজীবনের শুরুর দিকের বন্ধু নোমান। বছরের পর বছর একসাথেই কেটেছে আমাদের দিনরাত্রি। প্রথম যেদিন নোমান মাদরাসায় এলো, ততদিনে ভর্তি শেষ হয়ে দরস শুরু হয়েছে, তাঁকে দেখাচ্ছিল কিছু হতবিহবল। সম্ভবত, এটা ছিল নিজের পরিবেশ ছেড়ে ভিন্ন পরিবেশে আসার আকস্মিক অনুভূতি। এই অনুভূতি কমবেশি আমাদের সবার মাঝেই কাজ করেছিল।
নোমানের সাথে ছিল বড় একটা ট্রাংক, আকৃতিতে তার দীর্ঘদেহী মালিকের সাথে মানানসই। আমাদের ট্রাংকগুলোকে দেখাচ্ছিল বাচ্চার মত, চাইলে অনায়াসে নোমানের ট্রাংকে আমাদের ট্রাংকগুলো ঢুকিয়ে ফেলা যেত।

‘ইমরান সাহেব, নতুন এই চিড়িয়াটির ব্যাপারে আপনার মতামত কী?’ চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন শামীম ভাই।

‘এখনই মন্তব্য করার সময় আসেনি। আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে’ নিস্পৃহ কিন্তু সতর্ক কন্ঠে জবাব দিয়েছিলাম। অন্য কেউ হলে অনুমান করে একটা জবাব দিয়ে দেয়া যেত, কিন্তু আগের কদিনের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছিল শামীম ভাই হলেন সেই প্রজাতির মানুষ, যাদেরকে আপনি যদি বলেন, জিনিসটা এ-ই, তাহলে তাঁকে বুঝিয়ে দিতে হবে কেনো জিনিসটা সে-ই।

নোমানের ট্রাংক আশ্রয় নিল সিরাজের ট্রাংকের পাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল সিরাজ গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছে।
‘তোমার বাসা তাহলে উত্তরা? আমার বাসাও পাশেই’ সিরাজের কন্ঠে উত্তেজনা।
‘কোথায়?’ নোমানকে আগ্রহী মনে হলো।
‘এইতো নরসিংদী। মাধবদি’
সিরাজের এই জবাব কিছুটা হাস্যকর ছিল। শামিমভাই স্বভাবসুলভ স্থির কন্ঠে বললেন, সিরাজ সাহেবের কথাবার্তা নির্ভরযোগ্য নয়। তিনি প্রায়ই বেফাঁস কথাবার্তা বলেন।

-
এভাবে মাদরাসায় নোমানের প্রথম দিনটি শুরু হলো। খুব দ্রুত দেখা গেল সে আসর বসিয়ে ফেলেছে। হুন্ডার দরদাম, আইফোনের বৈশিষ্ট্য, নিম্বাজের চেয়ে হোয়াটসেপ উত্তম কেন, এসব বিষয়ে তার প্রচুর মতামত দেখা গেল। শেষমেশ শামীম ভাই বলতে বাধ্য হলেন, ভাই ইনি দেখি আধুনিক আলেম হবেন।

নোমানের সাথে তাল মিলালো আবদুল মাজিদ। সে এসেছিল দুবাই থেকে। নোয়াখালির আঞ্চলিক বাংলা বলতে পারত। এছাড়া বাংলা বলতেও পারত না, লিখতেও পারত না। তবে আরবী, উর্দু ও ইংরেজিতে বেশ ভালো দখল। তার বাসা ছিল বুর্জ আল আরবের কাছে। তার কাছেই জানলাম কিছুদিন আগে তার বাসার পাশে নাকি টম ক্রুজ নামে এক খারাপ লোক শ্যুটিং করেছিল। আবদুল মাজিদের এই গল্পে আমি বিশেষ আগ্রহ পেলাম না। কারণ বাল্যকাল থেকে আমি শুধু দুজন টমকে চিনতাম। একজন মার্ক টোয়েনের টম সয়্যার, অন্যজন টম এন্ড জেরির টম। তবে কেউ কেউ এই খারাপ লোকটিকে বেশ চিনতো। তারা আবদুল মাজিদের গল্পে আগ্রহ খুঁজে পেল।

-
নোমান এসেছিল এক কাজে। কাজ শেষ হতে ভাবলাম কোনদিকে যাওয়া যায়। আশিক যাত্রাবাড়িতে দইয়ের দোকান দিয়েছে। তার বিশেষ দাওয়াত তার দোকানে একদিন যেতেই হবে। দই জিনিসটির প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ আছে। গোলাকার মাটির পাত্রে শান্ত শুয়ে থাকা নরম ও আঠালো বস্তুগুলির মধ্যে এমন এক সম্মোহনী আকর্ষণ রয়েছে, চাইলেই আপনি একে আগ্রাহ্য করতে পারবেন না।
‘যাবি নাকি আশিকের কাছে?’ জিজ্ঞেস করলাম নোমানকে।
‘চল। অনেকদিন ওর সাথে দেখা নাই’ নোমান বললো।
-

আশিকের স্মৃতিগুলো একটু আনমনা করে দিল। আশিকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল নোমানের মাধ্যমে। জালালাইন পড়ি তখন। যাত্রাবাড়ি মাদরাসায় ভর্তি হয়েছি। বড় মাদরাসা। হাজার হাজার ছাত্র। আগে পড়েছি ছোট মাদরাসায়। তখন পুরো মাদরাসার সব ছাত্রকে চিনতাম। আর এখানে এসে দেখি নিজের জামাতের (ক্লাসের) সব ছাত্রকেই চেনার উপায় নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে যা হয়, পুরনো ছাত্ররা নতুনদের নানাধরনের হুমকির মধ্যে রাখে।

‘সাবধানে থাকবেন। সামান্য কারনে এখান থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়। আপনারা নতুন। আপনাদের অনিয়মের কারণে প্রতিদিন আমাদের কথা শুনতে হচ্ছে’ এ ধরণের সাবধানবানী থাকে তাদের কন্ঠে। আমাদের সময় আমরা যাদের কন্ঠে এসব শুনতাম তাদের একজন ছিলেন আরিফ জাব্বার। ভদ্রলোকের সাথে তখন সখ্যতা হয়নি, হয়েছে ফেসবুকে এসে। (এর কারণও স্পষ্ট। এখানে নতুন ছাত্র, পুরান ছাত্র, আমির, মামুরের ভেদাভেদ নেই। এখানে বাজে সাম্যের গান)
বছরের শুরুতে তাকরারের গ্রুপ করতে হবে। তাকরিম বেশ পেরেশান।

‘একটা ভাল আমির দরকার আমাদের। তবে অতিরিক্ত ভাল হলে সমস্যা। একটু দেখো কী ব্যবস্থা করা যায়’ আমাকে কয়েকবার আদেশ দিল সে।

কয়েকদিন পর নোমান জানালো ভালো একজন আমির পাওয়া গেছে। তাঁকে নানাভাবে যাচাইবাছাই করে দেখা হয়েছে। সে ভালো, তবে অতিরিক্ত ভালো নয়। সেই আমিরটিই হল আশিক। নোমান আশিককে টেনে এনে বসিয়ে দিল আমাদের মাঝখানে। 

আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে আমিরের প্রশ্নে আমরা আশিককে ভোট দিব। আমি, তাকরিম, নোমান, আবিদ আল আহসান, জুবায়ের শিকদার (জানি না সে কোথায়। সে নেই আমাদের কারো সন্ধানে। হয়তো সে আছে এই শহরে, অথবা সে নেই কোনো শহরে। তার সাথে আমাদের অনেক স্মৃতি, মান-অভিমান জমে আছে। জানি না সেই অভিমানেই সে হারিয়ে গেল কিনা। মানুষ মরে গেলে কবরটা দেখা যায়, জুবায়ের হারিয়ে গেছে, নেই তার কবরের চিহ্নটুকুও), শারফুদ্দিন, সবাই আশিককে ভোট দিলাম। পাতানো নির্বাচনে আশিক জিতে গেল। তারপর আমাদের অনেক সময় কেটেছে ঢাকা, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে। ঘোরাঘুরির কত স্মৃতি।

-
‘আমাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী কে ছিল বল দেখি’ নোমান নীরবতা ভেংগে প্রশ্ন করে। ফ্লাইওভার পার হচ্ছি তখন।
‘অবশ্যই শামীম ভাই। তবে আজিজুল হাকিম ভাই এগিয়ে গিয়েছিলেন পরিশ্রমের দিক থেকে’
‘আমাদের সাথের সবাই বেশ ভাল আছে। সবাই টুকটাক ছোট পরিসরে আছে, তবে আজিজুল হাকিম ভাই নিশ্চয় অনেক বড় হবেন’
‘ইনশাআল্লাহ। পরিশ্রম মানুষকে এগিয়ে নেয়’ উদাসকন্ঠে বলি।

-
আশিকের দোকান দেখে গেলাম রিয়াদের মাদরাসায়। ছাত্রজীবনের সেই গুলুগুলু রিয়াদ, এখন বেশ দায়িত্ববান স্বামী। নিজের জীবনের নানা গল্প শোনালো সে। এক সময় ছিল নসীম হিজাজি আর আলতামাশের ভক্ত। পরে আসলাম রাহির বইও অনুবাদ করেছিল। যাত্রাবাড়ি মাদরাসার সামনে এসে আশরাফউল্লাহ ভাইর সাথে দেখা। আমাদের জামাতের শান্ত ছেলেটি, যার ব্যাপারে বরাবর আমাদের সন্দেহ ছিল, তাকরারে অনুপস্থিতদের নাম তিনিই জমা দেন, যদিও পরে প্রমানিত হয়েছে অভিযোগ সত্য নয়। কথা শুরু হলে আর ফুরোয় না। কথায় কথায় সময় গড়াতে থাকে।
‘রাত বাড়ছে। চল ফিরে যাই’ নোমান বলে।
‘হুম। চল যাই’
একদিন ঃ ইমরান রাইহান
Next Post Previous Post