রাসুল(সা) কিভাবে যুদ্ধের কমান্ডার নিযুক্ত করতেন? বই নববী কাফেলা : Iftekhar Sifat - BanglaFeeds.info

রাসুল(সা) কিভাবে যুদ্ধের কমান্ডার নিযুক্ত করতেন? বই নববী কাফেলা : Iftekhar Sifat

 রাসুল স. এর ত্রিশজন কমান্ডার সূচনালগ্নেই ইসলাম কবুল করেছিলেন। তাঁদের একুশজন বদরী সাহাবি। যারা রাসুল স. এর নেতৃত্বে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এঁরা ছিলেন খঁাটি এবং গভীর ইমানের অধিকারী। আকিদায় ইখলাস ও একনিষ্ঠতা ছিল চুড়ান্ত পর্যায়ে। তারা চূড়ান্ত দৃঢ়ভাবে দ্বীনকে আকড়ে ধারণ করেছিলেন। এ কারণে রাসুল স. তাঁদের প্রতি পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস রাখতেন। নেতৃত্বের দায়িত্বের ক্ষেত্রে অন্যদের উপর তাঁদেরই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

তাঁদের মাঝে শুধু কুরজ ইবনে জাবের আল ফেহরী রা. হিজরতের পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। রাসুল স. তাঁকে একটি সারিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন দুঃসাহসী অশ্বারোহী ও নির্ভীক বীর। চমৎকার ভাবে আক্রমণ এবং পশ্চাদ্ধাবন করতে পারতেন। তিনি যে অভিযানের নেতৃত্ব পেয়েছিলেন, তা অশ্বারোহীদের দ্বারা গঠিত ছিল। যাদের কাজ ছিল দ্রুত লক্ষ্যস্থানে পেঁৗছে তৎক্ষণাত আক্রমণ করা। আর এ কাজের জন্য কুরজ ইবনে জাবের রা. ছিলেন উপযুক্ত ব্যক্তি।

তাঁর কমান্ডারগণের মধ্যে একজন উহুদ যুদ্ধের পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, যা ছিল হিজরী তৃতীয় সনে। তিনি হলেন আমর ইবনে উমাইয়া আদ দামরী রা.। অনন্য বীরত্ব এবং স্বপ্রণোদিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহনে এগিয়ে আসার কারণে রাসুল স. তাঁকে কমান্ডার বানিয়েছিলেন। তিনি উত্তমভাবে ইসলাম গ্রহন করেছিলেন।

পঁাচজন কমান্ডার মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা হলেন, ইবনে আবুল আওজা আস সুলাইমী, খালেদ ইবনে ওয়ালিদ আল মাখযুমী, আমর ইবনুল আস আস-সাহমী, উইয়াইনা ইবনে হিসন আল ফাযারী এবং আলকামা ইবনে মুজাযযির আল মুদলিজী রা.।

ইবনে আবুল আওজা রা. নিজ কওমের প্রতি একটি দাওয়াতি অভিযানের নেতৃত্ব পেয়েছিলেন। যেহেতু তাঁর কওমের ব্যাপারে অন্যের তুলনায় তিনিই বেশি জানতেন। তাদের ভিতরে ঢুকা ও বের হওয়ার পথগুলোর ব্যপারে জানতেন। কওমের লোকেরাও তাকে ভালো করে জানত। অন্যের তুলনায় তাঁর দাওয়াতেই তারা বেশি সাড়া দিবে। ইসলাম কবুলের জন্য প্রভাব ফেলতে তিনিই বেশি যোগ্য ছিলেন। কিন্তু তাঁর কওম তঁার ডাকে সাড়া দেয়নি বরং কুফরের উপরই অটল থাকে।

উইয়াইনা ইবনে হিসন রা. কে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কারণ তিনি গাতফান গোত্রের সরদার ছিলেন। তঁার কওমের লোকেরা তাঁর কথা শুনত ও মানত। সবাই তাঁকে সমীহ করত। রাসুল স. একবার তামিম গোত্রের একটি শাখা গোত্রের কাছে যাকাত উসুলের জন্য এক সাহাবিকে প্রেরণ করলেন। কিন্তু তারা তার কাছে যাকাত দিতে অস্বীকার করল। তখন রাসুল স. বললেন, ‘এরা যে কাজটা করল, তার সমাধান করার মত কে আছে?’ সর্ব প্রথম উইয়াইনা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন রাসুল স. তাঁকে পঞ্চাশজন বেদুইন ঘোড়সাওয়ার দিয়ে প্রেরণ করলেন। তাদের মাঝে কোন মুহাজির বা আনসারী সাহাবি ছিলেন না।

সম্ভবত উইয়াইনা রা. স্বেচ্চায় স্বপ্রণোদিত হয়ে সবার আগে প্রস্তুত হওয়ার কারণে রাসুল স. তাকে এমন দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যেখানে কোন আনসার বা মুহাজির সাহাবি ছিলেন না। কারণ তারা ছিলেন প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহনকারী মুসলিম যাদের উপর তাদের মতই প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহনকারীদের থেকে নেতৃত্বের উচ্চতর যোগ্যতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা ব্যতিত অন্য কারো কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব করা সমিচীন নয়। তবে কোন বিশেষ প্রয়োজনে ভিন্ন হতে পারে অথবা চুড়ান্ত কোন প্রজ্ঞার কারণে যা কোন বিবেকবান ব্যক্তির কাছে অস্পষ্ট রবে না।

স্পষ্ট বিষয় হচ্ছে, আল্লাহর নবী স. কখনোই প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহনকারীদের ছাড়া উইয়াইনা ও তার মত নতুন ইসলাম গ্রহনকারী কাউকে তার কোন সারিয়্যার কমান্ডার নিযুক্ত করতেন না, যদি উইয়ইনা অন্যদের পূর্বেই স্বপ্রনোদিত হয়ে এগিয়ে না আসত। যদি ইসলাম গ্রহনে অগ্রগামীদের থেকে থেকে কেউ তার পূর্বে এগিয়ে আসত তাহলে তিনিই হতেন নেতৃত্ব গ্রহনের অধিক উপযুক্ত। সুতরাং শুধু ইসলাম গ্রহনের ক্ষেত্রে অগ্রগামীতা ও ইসলামকে একনিষ্টভাবে সাহায্য করা ব্যক্তিকে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রগামী করে দিত ও যুদ্ধের সেনাদের কামান্ডিং এর পূর্ণ মর্যাদা প্রদান করত।

রাসূল স. এর সারিয়্যাগুলোর কমান্ডারদের জীবনী অধ্যয়ন থেকে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়; তাদের অধিকাংশই ছিলেন শুরু যুগের ইসলাম গ্রহনকারী মুহাজির ও আনসার। তাদের মধ্যে আশি শতাংশই ছিলেন মুহাজির ও আনসার রাজি.। ষাট শাতাংশ ছিলেন বদরী সাহাবী, আর বদরী সাহাবীগণ তো আন্যান্য সাহাবীদের থেকে মহান মর্যদার অধিকারী ছিলেন।

রাসুল স. কোন বেদুইন ও গ্রাম্য ব্যক্তিকে সভ্য ও শহরী লোকের উপর আমির বানান নি। সাঁয়ত্রিশজন কমান্ডারের মধ্যে পঁয়ত্রিশজনই ছিলেন শহরের আর দু’জন ছিলেন গ্রামের অধিবাসী। উইয়াইনা ইবনে হিসন যিনি নেতৃত্বের জন্য স্বপ্রনোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছেন এবং দাহহাক ইবনে সুফিয়ান কালানী রা. যিনি ছিলেন একজন সেরা বীর, যাকে শত অশ্বারোহীর সমপর্যায়ে গণ্য করা হত।

তাছাড়াও তিনি মদীনাতে নবী স.এর পাশে তরবারী ধারনকারী হিসেবে দীর্ঘ দিন অবস্থান করেছেন। মোটকথা এ দু’জনকে নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছিল বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ কারণে। শহরের লোককে রাসুল স. নেতৃত্ব দিতেন, যেহেতু শহুরে ব্যক্তি গ্রাম্য লোকের চেয়ে যুদ্ধবিদ্যায় বেশি পারদর্শী। এবং যুদ্ধের কষ্ট ক্লেশ সহ্যের ক্ষেত্রে তারা গ্রাম্য লোকের চেয়ে অধিক সক্ষম ও ধৈর্য ধারনকারী।

সারকথা, নেতৃত্ব পাবার জন্য মৌলিক দু’টি শর্ত; ইসলাম এবং যোগ্যতা। এই দুটো শর্ত কোন ভিন্নতা ছাড়াই সর্ব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

অন্য শর্তসমুহ হচ্ছে; প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী, বদরী সাহাবি, শহুরে ব্যক্তি হওয়া। তবে এই শর্তগুলো প্রয়োজনের ক্ষাতিরে বাতিলও হতে পারে।

রাসুল স. এবং আবু বকর ও ওমর রা. নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এ শর্তগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা উম্মাহর মধ্য থেকে আকিদা ও যোগ্যতায় সেরা ও নির্বাচিত ব্যক্তিদের নেতৃত্বের দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছিলেন। যাতে তাঁরা যুদ্ধে উম্মাহর বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারেন এবং শান্তিকালীন সময়ে উম্মাহকে উন্নতি অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে পারেন।

সেই জাতি কতই না ভাগ্যবান যাদেরকে দ্বীন ও যোগ্যতায় সেরা ব্যক্তিরা নেতৃত্ব দান করে!
রাসুল স. ও তাঁর সকল খলিফা প্রতিটি মুসলিমের গুণ ও বৈশিষ্টকে কাজে লাগাতেন। ইসলামী সমাজ নির্মানে সেগুলোকে ইট হিসেবে চয়ন করতেন। ফলে যে স্থানে যে ইট রাখা দরকার সে স্থানে সে ইটই রাখতেন। যাতে এই প্রাসা নিরাপদে উঁচু হতে হতে মজবুত ও শক্তিশালী হয়।।

উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত কমান্ডারকে নিয়োগ করাই ছিল রাসুল স. ও তাঁর খলিফাদের যুদ্ধ এবং শান্তিকালিন সময়ে সামরিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে বিজয় ও সফলতার অন্যতম কারণ।

রাসুল স. ইন্তেকালের সময় ইসলামী সমাজে অনেক কমান্ডার, আমির, আলেম, ফকিহ ও মুহাদ্দিস রেখে যান। যারা উম্মাহকে ইসলামের সকল অঙ্গনে বিজয়, সফলতা ও কল্যাণের দিকে পরিচালিত করেন। উম্মাহকে এগিয়ে নিয়ে যান সম্মান, মর্যাদা, সৌভাগ্য, হক ও হেদায়ের পথে। এই কমান্ডার ও নেতাগণ ছিলেন রাসুল স. এর মাদরাসা থেকে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত।

কমান্ডার নির্বাচনের এই জীবন্ত শিক্ষা বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে আরব ও সকল মুসলিমের গ্রহন করা উচিত। কমান্ডার হোক বা সাধারণ লোক, শাসক হোক বা জনগণ- তাদের উচিত এসব যোগ্যতা থেকে উপকৃত হওয়া এবং উপযুক্ত ব্যক্তি তার উপযুক্ত স্থানে বসিয়ে দেওয়া।।তবে অবশ্য প্রত্যেক নেতাই যোগ্য ব্যক্তি তৈরী করতে পারে না এবং যোগ্যতাকে চয়ন করে ঠিক জায়গায় রাখতে পারে না।

রাসুল স. ছিলেন উম্মাহর কল্যাণে নিজেকে ভুলে গিয়ে উম্মাহকে নিয়ে চিন্তা-ফিকিরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চূড়ায়। এ কারণে তাঁর বিদ্যাপিঠ থেকে বের হয়েছে বিভিন্ন সেক্টরের এবং বিভিন্ন অঙ্গনের সর্বকালের সর্বসেরা যোগ্য ব্যক্তিগণ।

এটা কোন সহজ বিষয় না। বিশেষত উম্মাহর স্বার্থে নিজের স্বার্থকে ভুলে যাওয়া। নিশ্চয় এটা ঐ নেতাদের জন্য খুবই কঠিন কাজ, যারা অন্যের স্বার্থের জন্য নয় বরং ব্যক্তি স্বার্থের জন্য নেতৃত্বের পদে সমাসীন হয়।

রাসুল স. সত্যই বলেছেন,
من استعمل رجلا من عصابة و فيهم من هو أرضي لله منه فقد خان الله و رسوله و المؤمنين . حديث صحيح.
“ যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায় থেকে এমন লোককে দায়িত্ব দিল, অথচ তাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে তার চেয়েও আল্লাহকে অধিক সন্তুষ্ট করতে পারে, তবে সে আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং মুমিনদের সাথে খেয়ানত করল।”

এটি মানব জীবনের এমন এক সামগ্রিক বয়ান, রাসুল স. সেটা কয়েক শব্দে বলে দিয়েছেন। কিন্তু এ কয়েকটি শব্দ কয়েক খন্ড কিতাবের কাজ করে দিয়েছে।
যুদ্ধের কমান্ডার