রামাদান আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ - ১ | মাহে রমজান এর প্রস্তুতি 2024
রামাদান; আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ-১
- Nazrul Islam
আমরা সিয়ামের (صيام) পারিভাষিক পরিচয় জানি। সবার কাছে মোটামুটি সুবোধ্য। তবে সিয়ামের আভিধানিক আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু অর্থ আছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, কোনোকিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখা। অর্থাৎ আল্লাহ ﷻ যেসব (হালাল) বিষয় থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন সেসব থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম (صيام)।
অন্য আরেকটি অর্থ হচ্ছে, চুপ থাকা। যেমন হযরত মারইয়াম আ.-প্রতি আল্লাহর ﷻ শেখানো কথা,
"اني نذرت للرحمن صوما فلن اكلم اليوم انسيا"
অর্থাৎ আমি আমার রাহমানের নির্দেশে নিজের ওপর চুপ থাকাকে ওয়াজিব করে নিয়েছি। আজ আমি কিছুতেই কথা বলব না। (মারইয়াম-২৬)
ক্ষুধা লাগলে আপনি খাবেন। খাওয়া আপনার জন্য হালাল। কিন্তু রামাদান মাসের দিনের বেলায় সেই হালাল কাজটাও আপনি করতে পারবেন না। পেটের ক্ষুধাপোকা চুঁচুঁ করলেও কিছুই করার নেই। পেটকে বলতে হবে, "না, আমার রবের নির্দেশ হল, খাওয়া যাবে না।"
পিপাসা পেলে ঢুকঢুক করে পানি পান করবেন। এটাই স্বাভাবিক। সে কারণে মাটি গভীরস্থ পানিকে আপনার জন্য আল্লাহ ﷻ সুপেয় করেছেন। পানি পান করা হালাল। কিন্তু রামাদান মাসের দিনের বেলায় সেই হালাল পানিও আপনি পান করতে পারবেন না। কারণ, আল্লাহ তা পান করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
বিবাহিত ভাইবোনেরা সুবিধাজনক যেকোনো সময় জৈবিক চাহিদা মিটাতে পারবেন। সেটা তাদের জন্য হালাল। কিন্তু রামাদান মাসের দিনের বেলায় সেই হালাল কাজটাও তারা করতে পারবেন না। আল্লাহ ঐ হালাল কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবে আপনি যেকোনো বৈধ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ কথাবার্তা বলতে পারবেন। ব্যবসায়িক বা সাংসারিক প্রয়োজনীয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া হালাল।
কিন্তু রামাদান মাসে সেই হালাল কাজেও সীমাবদ্ধতা আনতে হয়। খুব প্রয়োজন না হলে দুনিয়াবি কথাবার্তা বাদ দিয়ে শুধু রবের জিকিরে জিহ্বাকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে হয়। আর ই'তেকাফের সময় সেই হালাল কথাবার্তা থেকেও বিরত থাকতে হয়।
কারণ, আল্লাহর ﷻ নির্দেশ।
অর্থাৎ পবিত্র রামাদানে আল্লাহ ﷻ আপনাকে আমাকে হালাল কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। আবার পড়ুন, হালাল কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। খানাপিনা এবং স্ত্রী সহবাসের মতো হালাল কাজের কোন একটি যদি আপনি করে ফেলেন তাহলে আপনার সিয়াম ভেঙে যাবে।
এবার বলুন তো! হারাম কাজ করলে কীভাবে সেই সিয়াম আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে? বিচারটা আপনিই করুন।
এটা বোঝার জন্য খুব বড় মুফতি বা নামীদামী আলেম হওয়া জরুরি?
এবার আসুন বাকি এগারো মাসের আলাপে। যেই আপনি আল্লাহর নির্দেশে রামাদানে হালাল কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই আপনি কী করে রামাদানের বাহিরে হারামে জড়িয়ে যাচ্ছেন?
রামাদানে হালাল কাজ করার কারণে যদি আপনার সিয়াম ভেঙে যেতে পারে তাহলে রামাদানের বাহিরে হারামে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে আপনার সাথে আল্লাহর ﷻ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে না? ঈমানের ওপর আঘাত আসতে পারে না? কখনো বা ঈমান ভেঙে যেতে পারে না? উত্তর আপনিই দিন।
সুতরাং রামাদান হচ্ছে তাকওয়া অর্জনের আপার লেভেলের প্রশিক্ষণের মাস। আল্লাহর ﷻ বিধিবিধান পালনে নিজেকে প্রস্তুত করার সর্বোত্তম এবং কার্যকর কাল হচ্ছে রামাদান মাস।
আর সেই কারণেই আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন-
"یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِینَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ﴾
হে ঈমানদারগণ! পূর্ববর্তী জাতির মতো তোমাদের ওপরও সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (বাকারা-১৮৩)
রমাদান মাস ও কোরান ( 2024 )
নবুওয়াতের পঞ্চম বছর । কুরাইশদের অত্যাচার তখন চরমে । তখন একদিন আবু জেহেল খুব আপত্তিকর ভাষায় নবীজী সা: কে কাবা প্রান্তরে সিজদাবনত হতে নিষেধ করেছিল । এরপর একদিন নবীজী সা: কাবায় ঢুকে সালাতে দাঁড়ালেন । তা দেখে কুরাইশরা জড়ো হতে লাগল ।
বুঝতে পেরে নবীজী সা: কন্ঠস্বর আরও উঁচু করলেন । আল্লাহর কথাগুলো পাঠ করছেন স্বয়ং মুহম্মদ সা: , যা শিখিয়েছেন জিবরীল আ: নিজে । আমার নবীজী সা: পাঠ করছিলেন সুরা নাজম ।
আমরা নামকরা ক্বারীর তেলাওয়াত শুনলেই আনমনা হয়ে যাই । চিন্তা করা যায় কত সুন্দর আর হ্রদয়গ্রাহী হতে পারে সে কন্ঠ আর কতটা মোহাবিস্ট হওয়ার মত পরিবেশ হয়েছিল সেখানে ।
নাজমের শেষ আয়াত সিজদার, নবীজী সা: সিজদা অবনত হলেন। আর তার সাথে সিজদাবনত হলো বাঁধা দিতে আসা জড়ো হওয়া সব অবিশ্বাসীর দল । তারা মোহাচ্ছন হয়ে পড়েছিল, সারা শরীর যেন অসার, পা যেন নড়ছিল না তাদের । তাদের ঘোর কাটল সিজদা থেকে মাথা উঠিয়ে । বলে উঠল ‘বাঁধা দিতে এসে এ আমরা কি করলাম ‘?
ইবনুল কায়্যিম এর ‘রুহের রহস্য’ বইটি সবারই পড়া উচিত । এখন থেকে প্রায় সাতশ বছর আগে লিখা মহামূল্যবান এই বই ।
সেখান থেকে একজন কবরবাসীর আফসোস তুলে ধরছি ‘তোমরা যে আলহামদুলিল্লাহিরব্বিল আ’লামীন পাঠ কর, তা যদি আমি কবরে শুয়ে সওয়াবের আশায় পাঠ করতে পারতাম, তবে তা আমার জন্য দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম হতো ।’
তার মানে আমরা যারা জীবিত, একটা সেকেন্ডও আমাদের কাছে মহা দামী, মরে গেলেই কোরআনের একটা অক্ষরও আমি চাইলেও আর উচ্চারণ করতে পারবো না ।
তাহলে কত শত ঘন্টা আমি কোরআন থেকে দূরে, কখনো হিসাব মিলিয়েছি । আমি মুসলিম, এটা যে কত বড় সৌভাগ্য, আলহামদুলিল্লাহ । আর আল্লাহর কথাগুলো আমার হাতের নাগালেই, আমি ছুঁয়েও দেখছি না, এটা যে কত বড় দূর্ভাগ্য !
রামাদান মাসই হলো সেই মাস, যাতে কোরআন নাযিল হয়েছে । সুরা বাকারা-১৮৫
আজ সন্ধ্যা থেকেই রমজান শুরু । আজ সন্ধ্যা থেকে শুরু হোক কোরআনের সাথে সখ্যতা ।
কোরআনের একটা অক্ষর উচ্চারণে দশ নেকী । সুরা ইখলাসে সাতচল্লিশটা অক্ষর । তারমানে একবার সুরা ইখলাস পাঠেই চারশ সত্তর নেকী ।
আর তিন বার ইখলাস পাঠে এক কোরআন খতমের সওয়াব । এটা হচ্ছে রমজানের বাইরে বাকী মাসগুলোর হিসাব ।
রমজানের এটা বেড়ে আরও যে কতগুণ বেশী -আল্লাহই ভাল জানেন ।
আমাদের মাফ করে দেয়ার জন্য আল্লাহ কতটা আগ্রহী, কত সহজ রাস্তা করে রেখেছেন ।
শুধু একটু অনুতপ্ত মনে ফিরে আসতে হবে । একটা অপরাধী অন্তর আল্লাহর কাছে কত যে প্রিয় !