ইমরান নজর - ভালো, খারাপ, ভন্ড নাকি আসল আলেম? তার কিছু বিশ্বাসের বিশ্লেষণ

 ইমরান নজরের কুফুরি বিশ্বাস

ইমরান নজরের ভ্রান্তি সহজে বুঝার জন্য তার চিন্তার প্যারাডাইমটা বুঝা জরুরী। আমি তার বিভিন্ন মতামত ও চিন্তাধারা নিয়ে ভাবার পর তার বিশ্লেষণ ও চিন্তা কাঠামোর দুটি ভিত্তি বা কক্ষ পেয়েছি। তার সকল উদ্ভট গবেষণা আর ভ্রান্ত বক্তব্য এই দুই কক্ষকে সামনে রেখেই আবর্তন করে। যেকোন আহলে ইলম ( জাহেল নয়) তাকে পর্যালোচনা করলে এই দুটি কক্ষ আবিষ্কার করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ। ( রেফারেন্স কমেন্টে থাকবে)

১। আকলপূজাঃ
ইমরান নজরের চিন্তার প্রথম ভিত্তি হল আকল পূজা। সে নিজের আকলকে সবকিছুর উর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। তার কাছে মুসলিম উম্মাহর ১৪শ বছরের লক্ষ্য লক্ষ্য আলেম, ফকিহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ক্বারী- এদের মতামতের কোন মূল্য নেই। সে নিজেকে উম্মাহর ১৪শ বছরের স্কলারদের থেকে শ্রেষ্ঠ চিন্তক মনে করে। এমনকি সে সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী তিন যমানার সালাফদের মানহাজকেও উপেক্ষা করে, যারা এই উম্মাহর শ্রেষ্ঠ অংশ। একমাত্র নিজের আকলপূজার কারণেই তার এই দাম্ভিকতা ও আকলের অবাধ্যতা। আকল পূজা তাকে কুফুরি পর্যন্ত নিয়ে গেছে।
একঃ নিজের আকলপূজা করতে গিয়ে সে কুরআনে কারিমের আয়াতে ভুল ধরেছে।
وَ اِنَّهٗ لَعِلۡمٌ لِّلسَّاعَۃِ فَلَا تَمۡتَرُنَّ بِهَا وَ اتَّبِعُوۡنِ ؕ هٰذَا صِرَاطٌ مُّسۡتَقِیۡمٌ
সুরা যুখরুফ, আয়াত ৬১। এই আয়াতের লা ইলমুন শব্দকে সে ভুল দাবি করে সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে উম্মাহর সকল আলেমদের উপর কুরআনকে বিকৃত করার অপবাদ দিয়েছে। তার দাবি, এখানে লা ইলমুন এর জায়গায় লাআলামুন হওয়ার কথা। মানুষরা এটা বিকৃত করে দিয়েছে নাঊযুবিল্লাহ।

এই কুরআন কেয়ামত পর্যান্ত সংরক্ষিত থাকবে শব্দ ও মর্মগতভাবে। আল্লাহ নিজে এর সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরিল আলাইহিস সালাম থেকে কুরআনের শব্দ ও অর্থ দুটোই সংরক্ষণ করেছেন, তিনি সাহাবায়ে কেরামের কাছে বিনা অদলবদলে পৌঁছে দিয়েছেন, সাহাবায়ে কেরাম তাদের পরবর্তী তাবেয়ীদের কাছে, এভাবে চেইন বাই চেইন কুরআনের শব্দ ও অর্থ অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত থাকবে।

এজন্য ফুকাহায়ে কেরামের ঐক্যমতে, কেউ যদি কুরআনে বিকৃতি ঘটার দাবি করে তবে সে কুফুরি করল। আর ইমরান নজর এই কুফুরি কাজটাই করেছে। নিজের জাহালাতপূর্ণ আকলের পূজা করতে গিয়েই সে এমন দাবির অবতারণা করেছে। তার যুক্তি ছিল, লা ইলমুন শব্দে নাকি অর্থ বনে না। অথচ সাহাবায়ে কেরাম থেকে আজ পর্যন্ত সকল মুফাসসির ও উলামায়ে কেরামের লা ইলমুন থেকেই যথার্থ অর্থ আসাকে মেনে নিয়েছেন।

সে সুরা নামলের ৮২ নং আয়াতেও শব্দ বিকৃত হওয়ার মত কুফুরি দাবি করেছে।

দুইঃ হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত হয়ে পুনরায় আগমন করবেন- এটা আহলুস সুন্নাহর মৌলিক একটি আক্বীদা এবং তাওয়াতুরে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত।

ইমরান নজর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত হিসেবে ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনকে অস্বীকার করেছে। ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন অকাট্যভাবে প্রমাণিত। আর দ্বীনের অকাট্য বিষয়কে অস্বীকার করা কুফুর। ইকফারুল মুলহিদিনে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি রহিমাহুল্লাহ গোলাম আহমাদ কাদিয়ানির কুফুরিসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে দুই নাম্বারেই ইসা আলাহিস সালামের আগমন অস্বীকার করার ব্যাপারটিকে নিয়ে এসেছেন। উম্মতের ঐক্যমতে, ঈসা আলাইহিস সালামের আগমণকে অস্বীকার করা কুফুর।

( আগের পোস্টেও তার অনেক ভ্রান্তির কথা আমি উল্লেখ করেছি। কমেন্টবক্সে সেই পোস্টের লিংক সকল তার সকল ভ্রান্তির রেফারেন্স দিয়ে দিব ইনশাআল্লাহ)

২। রাশান সাম্রাজ্যের দালালিঃ
এটা ইমরান নজরের চিন্তার দ্বিতীয় কক্ষ। তার অধিকাংশ গবেষণা ও চিন্তা রাশান ব্লকের একনিষ্ঠ অনুচর হিসেবেই আবর্তিত হয়। সিরিয়ার নির্যাতিত সুন্নি মুসলিমদের উপর শিয়া রাফেজী ও রাশিয়ার আগ্রাসনকে উৎযাপন করা, সুন্নি মুসলিমদের নিন্দা করা, পুতিনের গুণগান গাওয়া, উইঘুরের নির্যাতিত মুসলিমদেরকে দাজ্জালের অনুসারী বলে বিদ্রুপ করা, তাদেরকে কাফের বলা ও চায়নাদের জেনোসাইডকে সমর্থন দেয়া, শিয়াদের প্রশংসা ও নেতা মানা, ইয়াজুজ মাজুজের থিওরি, আয়া সোফিয়া খ্রিষ্টানদের অধিকার বলে দাবি করা, বসনিয়ার জেনোসাইডকে অস্বীকার সহ তার অসংখ্য সিদ্ধান্ত ও গবেষণা ডুগিন পুতিনের স্বপ্নরাজ্যের দালালির জায়গা থেকেই আবিষ্কৃত। জানা যায়, আল্যাক্সেন্ডার ডুগিনের সাথেও তার সম্পর্ক আছে। ডুগিন হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার পরামর্শে পুতিন এক রাশান স্বপ্নরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাচ্ছে। ( কমেন্টবক্সে একটা লেখার লিংক দিচ্ছি ডুগিন সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য)

তার কাছে কুরআন সুন্নাহ ও শরীয়তের তেমন গুরুত্ব নেই। তার মূল কক্ষ হল এই আগ থেকে নির্ধারিত এজেন্ডা, আর এই এজেন্ডার তাত্ত্বিক রূপ দেয়ার জন্য সে কুরআন সুন্নাহর নসকে যখন যেভাবে ইচ্ছা ক্ষতবিক্ষত করছে। সালাফদের ফাহমকে উড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবেই সে আকলপূজা আর রাশান সাম্রাজ্যের ডকটিনের সেবা প্রকল্পে কুফুরি ও ভ্রষ্টতার প্রচার করে যাচ্ছে।

এগুলো হল তার চিন্তাধারার ভ্রান্তি ও দ্বীন বিকৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট। তার ব্যক্তিজীবনও বিতর্কিত। সম্প্রতি তার তার ব্যক্তিজীবনের ভয়াবহ কিছু ফাহেশা কাজের তথ্য ফাঁস হয়েছে। বেরিয়ে এসেছে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা। কিন্তু মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় আমাদের আগ্রহের জায়গা নয়৷ দ্বীন সম্পর্কে তার কুফুরি ও যানদাকাপূর্ণ কথাবার্তাই আমাদের জন্য বেশি গুরুত্ব ও ফোকাসের দাবি রাখে।

তার ভ্রান্তিগুলো শাখাগত বিষয় নয় যে এড়িয়ে যাওয়া যায় কিংবা তার ব্যাপারে চুপ থাকা যায়। বরং সে তার ভয়াবহ সব বক্তব্যের মাধ্যমে কুফুরির সীমায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু শেষ যমানার ফ্যান্টাসিতে ফেলে যেই ফ্যানবয়জ সে তৈরি করেছে তারা একটা মোহের ভিতর আটকে আছে। যার জন্য তারা ইমরান নজরের কুফুরি ও যিনদিক মার্কা মতামতসমূহ স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে। তারা আমাদের খণ্ডনসমূহকে ব্যক্তিগত আক্রোশ হিসেবে নিচ্ছে। তারা যদি আন্তরিকভাবে মোহ থেকে বেরিয়ে শরীয়ার মাপকাঠিতে দেখে, তবে অবশ্যই এই ব্যক্তি কখনোই সমর্থনযোগ্য, অনুসরণযোগ্য ও প্রচারযোগ্য হতে পারে না। বরং তাকে সর্বাত্মকভাবে প্রত্যাখ্যান করাই শরীয়ত অনুযায়ী কাম্য। যেমনটা ইউকেতে ঘটেছে। সে সম্প্রতি ইউকেতে সফর করেছিল কোন মসজিদই তাকে গ্রহণ করেনি।



১। কুরআন বিকৃতির দাবিঃ
সুরা নামল এর ৮২ নং আয়াত সম্পর্কেঃ
২। ঈসা আলাইহিস সালামের আগমণকে অস্বীকারঃ

তার ভ্রান্তিসমূহের রেফারেন্স লিংকঃ



রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বের যেই অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এটাকে কেন্দ্র করে ভ্রান্ত ইমরান নজরের বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপস ভাইরাল হচ্ছে। ইমরান নজর সম্পর্কে না জেনে অনেক ভাইই সেগুলো শেয়ার করছেন। আবার কেউ কেউ ইমরান নজরের ভ্রান্ত চিন্তাকে গিলেও ফেলছেন।

ইমরান নজরের চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানপদ্ধতি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সে একই সাথে মুতাযিলা চিন্তাধারার ও শিয়াপ্রেমী একজন লোক। সালাফে সালেহীন থেকে প্রজন্ম পরম্পরা যেই ইলম ও চিন্তাপদ্ধতি আমরা লাভ করেছি সেই এর থেকে বিচ্ছিন্ন। এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে। মুতাযিলাদের মত সালাফদের ফাহম বাদ দিয়ে কুরআন সুন্নাহর ভ্রান্ত ব্যাখ্যা সে করে। এমনকি নিজের আকলের সাথে না মিললে বিশুদ্ধ হাদীসকে পর্যন্ত সে অস্বীকার করে বসে।

রাসুলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আইশা রাদ্বিঃ এর ৬ বছরে বিবাহ হওয়ার মর্মে বর্ণিত সুপ্রমাণিত হাদিসকে অস্বীকার, রজমের বিধানকে অস্বীকার, উইঘুরের নির্যাতিত মুসলিমদের দাজ্জালি বাহিনী বলে তিরস্কার, শিয়াদের নেতা খোমেনিকে ইমাম মানা ও বিপরীতে সুন্নিদের প্রোটেস্টেন্ট বলে কটাক্ষ করা, বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত সকল মুসলিমদের নিয়ে ঠাট্টা করা, হাদীসের মর্মের বিকৃতি ঘটিয়ে ইউরোপীয় ও জিউসদের ইয়াজুজ মাজুজ দাবি করা, হাদীসে বর্ণিত দাজ্জালের অবস্থানকালকে ইউরোপীয় ও আমেরিকান শাসনকাল দিয়ে ব্যাখ্যা সহ ফিতান ও কিয়ামতের আলামত সংক্রান্ত অদ্ভুত ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করা- এসবই ইমরান নজরের কীর্তি৷

এই ভুলগুলো শাখাগত কোন ভুল নয়। বরং পদ্ধতি, আদর্শ ও আক্বীদা কেন্দ্রিক ভুল। তার এই ভুল চিন্তা ও পদ্ধতি আহলুস ওয়াল জামাতের পরিপূর্ণ মুখালেফ। যার ফলে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ থেকে বিচ্যুত ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবেই তার থেকে মুসলিমদের সতর্ক থাকতে হবে। তার প্রতি মানুষদের ফ্যান্টাসি তৈরির প্রধান কারণ হল, কিয়ামতের আলামত আর ফিতান নিয়ে রাজনৈতিক ব্যাখ্যার সাথে মিশিয়ে অলীক থিওরি পেশা করা। যার ফলে এক শ্রেণির যুবকদের ভিতর নেতিবাচক ও ভ্রান্ত কিছু প্রবণতা প্রবেশ করেছে।

এক. ফিতানের হাদীসগুলোকে বর্তমান সময়ে প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হয়েছে। অনেক আজগুবি মনগড়া ব্যাখ্যার আবিষ্কার হয়েছে।
দুই. শরয়ী বিধানের আলোকে যেই দায়িত্ব আমাদের উপর ন্যস্ত হয় সেই বোধের জায়গাটা দখল করে নিয়েছে ফিতানের ফেন্টাসি। অর্থাৎ একটা দায়িত্ব যেটা শরয়ী দলিলের আলোকে আমার উপর বর্তায় সেটাকে ফিতানের জায়গা থেকে পালনীয় মনে করে করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে, শরয়ী তাকলীফের জায়গা থেকে নয়।
তিন. হতাশাময় জীবনবোধ এবং প্রোডাক্টিভ লাইফ থেকে দূরে থাকার এক প্রকার অলসভাব তৈরি করেছে। এবং এই জঘন্য অবস্থাকে ফিতান দিয়ে জাস্টিফাই করার মনোভাব তৈরি হয়েছে।

মূলত রাসূলের মৃত্যুই ছিল এই উম্মাহর জন্য একটা ফিতনা। এরপর খুলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকে ফিতনার খেলা শুরু হয়। এবং এটাই সত্য যে, ১৪০০ পর ফিতনার ভয়াবহতা ও মাত্রা অনেক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বলা যায়, আমরা চরম ফিতনার একটি যমানায় বাস করছি।

কিন্তু শেষ যমানার ফিতানগুলো মুতাশাবিহাত পর্যায়ের। এই সংক্রান্ত হাদিসগুলোর বাহ্যিক অর্থকে বিনষ্ট করে সুনিশ্চিতভাবে কোন ঘটনার উপর নির্দেশ করানো আহলুস সুন্নাহর পদ্ধতি না।কখন কি ঘটে আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন। কিন্তু আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, শরয়ী আহকামের জায়গা থেকে সার্বক্ষণিক যেই দায়িত্ব অর্পিত হয় সেটা পালন করতে হবে। হতাশ ও আন প্রোডাক্টিভ হলে চলবে না।

চলমান সকল ঘটনার উপর ফিতানের হাদিসকে জোর করে ফিট করানোর অতিপ্রবণতার তো আমাদের প্রয়োজন নেই। ফিতানের বর্ণনার সাথে কোন ঘটনা যুক্ত হলে আমি উক্ত ঘটনার ব্যাপারে সতর্ক হব, কিন্তু শরীয়তের কোন আহকামের সাথে উক্ত ঘটনা যুক্ত হলে আমি সতর্ক হব না- এই ধরণের মানসিকতা ভ্রান্তি কর। এই মানসিকতা ফ্যান্টাসি তৈরি করে, দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন করে তোলে না।
- Iftekhar Sifat
Next Post Previous Post