আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধঃ আর্মেনিয়ার বনাম আজারবাইজান

আর্মেনিয়ার বনাম আজারবাইজানঃ যুদ্ধ ইতিহাস ধর্ম  

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে লিমিটেড যুদ্ধ চলছে। অধিকাংশরা যুদ্ধকে মুসলিম আজারবাইজান বনাম খ্রিস্টান আর্মেনিয়ার যুদ্ধ মনে করে বসেছে। অথচ এখানে নেই কোনো জিহাদ নেই কোনো ক্রসেড।

 ধর্মীয় যুদ্ধের নামে চলছে জাতীয়তাবাদের লড়াই, গোত্রবাদের লড়াই। আর্মেনীয়রা এপস্টোলিক চার্চের অনুসরণ করে, রোমান ক্যাথোলিক বা গ্রিক-রাশান অর্থডক্স চার্চের নয়। 

আর ক্রুসেড হল খ্রিষ্টান ক্যাথলিকদের টার্ম। আজারবাইজানীদের ৯০% হল ইছনে আসারি শিয়া। ইরানীদের মত। ইরানের পর পারসেন্টেজ হিসেবে আজারবাইজান হল শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বিতীয় রাষ্ট্র। কিন্তু একই ধর্মের হলেও ইরান প্রতিবেশী আজারবাইজানকে শত্রু মনে করে, এবং আর্মেনিয়াকে মনে করে বন্ধু।

এখন শিয়া আজারবাইজানের বিপক্ষে আর্মেনিয়াকে সাপোর্ট করছে শিয়া ইরান। আর সুন্নি তুর্কি-পাকিস্তান সাপোর্ট করছে আজারবাইজানকে। আবার সুন্নি সৌদি-আরব আমিরাত আর্মেনিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।


 শিয়া-সুন্নি, ক্যাথোলিক-অর্থডক্স এই সব শব্দের কারনে এই দুই রাষ্ট্রের যুদ্ধাবস্থা বুঝতে গিয়ে অনেকে হিমশিম খায়। এই সব ঝেড়ে ফেলে বুঝতে হবে বর্তমান অধিকাংশ যুদ্ধের মত এটাও একটি জাতীয় স্বার্থের যুদ্ধ, কোনো ধর্মীয় যুদ্ধ নয়।


আজারবাইজানের নাগরিকদের আযর বলা হয়। আযররা তার্কি ভাষায় কথা বলে। শিয়া হলেও এদের জাতিগত মিল রয়েছে তুর্কিদের সাথে। এই আযরদের বিশাল একটি অংশ যুগ যুগ ধরে ইরানে বসবাস করে আসছে।


 এদের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। ইরানের মোট জনগণের শতকরা ২০ ভাগ হল আযররা। আজারবাইজান শক্তিশালী হলে ইরানে থাকা আযররাও শক্তিশালী হবে। এমনকি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবী তুলছে পারে, ঠিক যেভাবে ইরাক-সিরিয়া-তুর্কিতে থাকা কুর্দিরা পৃথক রাষ্ট্রের দাবী করছে।


এটাই হল ইরানের ভয়।


এই কারনে শিয়া হয়েও ইরান তাদের শত্রু। অন্যদিকে জাতিগত মিল থাকায় তুর্কি তাদের বন্ধু। তুর্কির ফাইটার আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধ করছে।


 পাকিস্তান সব সময় তুর্কির পক্ষে অবস্থান নেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এই যুদ্ধে পাকিস্তানও যোগ দিয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে নয়, তবে তুর্কির ফাইটার চালক হিসেবে, কেননা তুর্কির অধিকাংশ পাইলট হল পাকিস্তানী।


এই দুই দেশের যুদ্ধে অনেকে চোখ রাখছে আধুনিক সমরাস্ত্রের ব্যবহার ও জিওপলিটিক্সের গতি পরিবর্তন দেখার জন্য। ধর্মীয় যুদ্ধের খবর জানতে হলে আফগানিস্তানে চোখ রাখুন। 


সেখানে মুসলিম মুজাহিদের সামনে খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখতে পাবেন।

- Kaisar Ahmed 



 আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধ কি ইসলামি যুদ্ধ ?

দুঃখজনক হলেও নিগূঢ় সত্য, বর্তমানের কোনো ইসলাম প্রধান রাষ্ট্র শুধুমাত্র ইসলামের খাতিরে ভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্বে বা যুদ্ধে জড়ায় না। তারা যুদ্ধ করে ক্ষমতা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থে।

তবুও দুটো মুসলিম দেশ এক হয়ে হিন্দু বা খ্রিস্টান ধর্ম প্রধান কোনো রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে জড়ালে সেই যুদ্ধকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা জিহাদ বলে চালিয়ে দেয়। এরপর তারা ক্রুসেডের নিয়তে দলবদ্ধ হয়ে ইসলাম ঘেঁষা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, ঠিক তখনো মুসলিম নামধারী শাসকরা জিহাদকে সন্ত্রাসবাদের সাথে তুলনা করে এর মূল উৎখাতে মরিয়া থাকে। এই মুসলিম শাসকরা যে কতো বড় বেকুব তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

এই চিত্রটি হুবহু চিত্রায়িত হচ্ছে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধে। খ্রিস্টান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অস্ত্রধারণকে জিহাদ বলা হচ্ছে। আজারবাইজানের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়েছে দুটো মুসলিম প্রধান দেশ—এক. তুরস্ক, দুই. পাকিস্তান। তুরস্কের সাথে আজারবাইজানের সম্পর্ক বেশ পুরনো। অনেকেই এক জাতির দুই দেশ বলে। তুরস্কের সিংহভাগ গ্যাস আসে আজারবাইজান থেকে। আর পাকিস্তানের সাথে আজারবাইজানের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। আজারবাইজান রাষ্ট্রীয়ভাবে পাকিস্তানের দাবির পক্ষে। তারই রিটার্ন হিসাবে কারাবাখ ইস্যুতে পাকিস্তান আজারবাইজানকে সমর্থন দিচ্ছে। এখানে ইসলামিক চিন্তা মোটেও নেই।

বাস্তবতা হচ্ছে, আজারবাইজানের কিছু মানুষ শিয়া, অধিকাংশ লোক সেক্যুলার। সরকারও সেক্যুলার। সেদেশে পানির মতো মদ খাওয়া বৈধ। প্রায় প্রতিটি দোকানে পর্ক পাওয়া যায়। পুরোপুরি ওয়েস্টার্ন কালচারে অভ্যস্ত তারা। আজারবাইজান রাষ্ট্রেই ইসলাম চরমভাবে নিগৃহীত। সেখানে আবার ইসলামি চেতনার কী আছে?

এগুলো বিশ্লেষণ করার সময় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নেই। তারা দেখেছে, আজারবাইজান-তুরস্ক-পাকিস্তান একজোট হয়ে প্রাচীন খ্রিষ্টান রাষ্ট্র আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে করছে। ব্যাস, এটা জিহাদ ছাড়া আর কিছু নয়। ভারত সরাসরি একে ধর্মীয় আগ্রাসন বলে বিশ্বকে খেপিয়ে তুলছে। তারা আর্মেনিয়াকে ইসলামি টেররিস্ট (?) থেকে বাঁচাতে বিশ্বকে এক হওয়ার আহবান জানাচ্ছে।

কিছু ফুটেজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে দেখানো হচ্ছে, তুরস্ক সিরিয়া থেকে এবং পাকিস্তান নিজ দেশ থেকে মুজাহিদদেরকে নিয়া যাচ্ছে আজারবাইজানে। এই প্রোপাগান্ডাটা বেশ ভাইরাল হয়েছে ইতোমধ্যে।

কথা একটাই—ক্রুসেড চালানো বৈধ, কিন্তু জিহাদের নাম নেওয়া পর্যন্ত গুরুতর অপরাধ। এরপরও মাথামোটা মুসলিম শাসকরা বুঝে না, কীভাবে তাদেরকে কাবু করে রাখছে ক্রুসেডাররা।
- Nazrul Islam

আর্মেনিয়ার বনাম আজারবাইজান : রাশিয়া ও তুরস্ক

বিতর্কিত নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দখলকে কেন্দ্র করে লাগা আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার যুদ্ধের ব্যাটলগ্রাউন্ডটা খুবই কমপ্লেক্স। এর পিছনে রয়েছে জিও-পলিটিক্স, বহির্বাণিজ্য এবং ভূ-অর্থনীতি। সরাসরি যুদ্ধে রয়েছে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়া, কিন্তু যুদ্ধ-আয়োজক হিসাবে রয়েছে অনেক দেশ। তবে রাশিয়া এবং তুরস্কের সংশ্লিষ্টতা একদম স্পষ্ট।
আর্মেনিয়া খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশ। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান মতে প্রায় ৯৭ ভাগ জনগণ খ্রিস্টান। তারা সুপ্রাচীন আর্মেনিয়ান অ্যাপোস্টলিক চার্চের সদস্য। এই চার্চটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম শতাব্দীতে।
ঐদিকে আজারবাইজান হচ্ছে শিয়া প্রধান দেশ। ইরানের ভ্রাতৃপ্রতিম। একসময় ইরানেরই অংশ ছিল। পরবর্তীতে আলাদা হয়। তবে শিয়া পরিচয়ের বাহিরেও তাদের একটা শক্তিশালী পরিচয় আছে। তদের সিংহভাগ আপাদমস্তক সেক্যুলার। বর্তমান সরকার তুখোড় সেক্যুলার। কামাল আতাতুর্কের চেয়ে কম নয়।
মজার ব্যাপার হল, আজারবাইজান শিয়া প্রধান হলেও ইরানের সাপোর্ট পাচ্ছে না। ইরান সাপোর্ট করতে যাচ্ছে খ্রিস্টান দেশ আর্মেনিয়াকে। আর্মেনিয়ার সাথে ইরানের চমৎকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। রয়েছে রেল এবং গ্যাস পাইপলাইন সংযোগ। তবে তুরস্ক কিন্তু ঠিকই আজারবাইজানকে সামরিক সহযোগিতা দিয়ে পাশে রয়েছে। কারণ, তুরস্ক সবচেয়ে বেশি গ্যাস আমদানি করে আজারবাইজান থেকেই। রাশিয়া নির্ভরতা কমিয়া আনা তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
ঐদিকে রাশিয়া সাপোর্ট দিচ্ছে আর্মেনিয়াকে। রাশিয়ার ৪৬২৫ তম বিমানঘাঁটি স্থাপন করেছে আর্মেনিয়াতে। সেদেশে রাশিয়ার ৫০০০ সৈন্য রয়েছে। আর্মেনিয়া রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্র্যাটি অর্গানাইজেশনেরও (CSTO) সদস্য। এটা নিয়ে অন্যদিন বলব।
এদিকে পাকিস্তান আজারবাইজানকে সমর্থন দিচ্ছে। পাকিস্তান অত্যাধুনিক জেএফ-১৭ থান্ডার দিয়ে পাশে থাকার চিন্তাভাবনা করছে। আজারবাইজানের সাথে পাকিস্তানের একটা অদ্ভুত মিল আছে। আজারবাইজান আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধ করছে নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দখলকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তান ভারতের সাথে লেগে থাকে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। এদিক দিয়ে আজারবাইজানের অবস্থান পাকিস্তানের মতো। আর আর্মেনিয়ার অবস্থান ভারতের মতো। সেই কারণেই পাকিস্তান আজারবাইজানের প্রতি একটু দুর্বল। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো আরকি!
ভারত আবার আর্মেনিয়াকে সাপোর্ট দিচ্ছে। তবে ভারতের অকৃত্রিম বন্ধু ইসরাইল কিন্তু আজারবাইজানের সাথেই আছে। কারণ, আজারবাইজান সব যুদ্ধাস্ত্র কেনে ইসরাইল থেকে। বিক্রেতা তো ক্রেরার পক্ষেই থাকবে, তাইনা? যুগটা তো পুঁজিবাদের; সাম্যের নয়।
এই খিচুড়ি কীভাবে খায় ন্যাটো, তাই দেখার পালা এবার।
এ বিষয়ে আরও বিস্তৃতভাবে কিছু লেখলে কেমন হয়?
- Nazrul Islam
Next Post Previous Post