ইসলামি ইতিহাস এবং ইনসাফ ও জুলুমের বিরুদ্ধে ইসলামি বিচার ব্যবস্থা

ইনসাফ ও জুলুমের বিরুদ্ধে ইসলামি বিচার ব্যবস্থাঃ ব্যাবিলনের ঘটনা ও আমাদের শিক্ষা


১।
ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুচাঁদ নেজারের রাজসভার দুজন প্রভাবশালী আমাত্য তদানীং এক সুন্দরী সাধবি নারীকে অপকর্মের প্রস্তাব দিলে সেই নারী তা প্রত্যাখ্যান করলেন।

এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে সম্রাটের কাছে অভিযোগ করলেন সেই নারীর বিরুদ্ধে। বললেন, এই নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে হবে। তারা দুজনেই নিজেদের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে দাবি করলেন।

পুরো শহর জড়ো হলো দণ্ড কার্যকরের ঘটনা দেখতে। ভিড়ের মধ্য থেকে এক যুবক সম্রাটের দাঁড়িয়ে সামনে বললেন, যদি তিনি অনুমতি দেন তবে এই অভিযুক্ত নারী যে নির্দোষ তিনি তা প্রমাণ করে দিতে পারবেন।

সম্রাট যুবকের দৃঢ়তায় বিস্মিত হয়ে অনুমতি দিলেন। যুবকটি প্রথমে সেই দুই সাক্ষীকে আলাদা হওয়ার কথা বললেন। এরপর পৃথকভাবে তাদের জিজ্ঞাসা করলেন দুটি প্রশ্ন।
এক. কখন তারা তাকে ব্যভিচার করতে দেখেছে।
দুই. কোথায় এই ঘটনা ঘটতে দেখেছে?

তারা দুজনে একে অপরের অনুপস্থিতিতে আলাদা আলাদা উত্তর দিল। একজন বললো চাঁদনি রাতে, মাঠে। আরেকজন বললো দিবালোকে, নগরের প্বার্শস্থ বাগানে।

তারা যে মিথ্যাবাদী তা স্পষ্ট হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সেই নারীও নির্দোষ প্রমাণ হলো। এই যুবকটি ছিলেন দানিয়াল আ.। বনী ইসরাইলের নবী।

এই ঘটনার জন্য তাঁকে পৃথিবীর প্রথম আইনজীবী বলা হয়। যিনি অন্যের পক্ষ নিয়ে আদালতে দাঁড়িয়েছেন। জেরা করেছেন, ক্রস চেক করেছেন। এটা ইসরাইলি রেওয়ায়ত। ঘটনাটা বাইবেলেও আছে।

উমার ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. বিচারক নিয়োগকালে বলতেন,
'যখন কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে কোনও আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের একটা উপড়ানো চোখ নিয়েও হাজির হয় তবুও দণ্ডপ্রদানে তাড়াহুড়ো করো না। বরং অপেক্ষা করো। হতে পারে অপরপক্ষের দুটো চোখই উপড়ে দেওয়া হয়েছে।'*

ইসলামি বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা হলো অন্যতম মূলনীতি। বলা যেতে পারে বেসিক প্রিন্সিপ্যাল। নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করতে সর্বাবস্থায় ইসলাম অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রাখে। ইসলামে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য।

ইসলাম শুধু আভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারই নিশ্চিত করে না বরং অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে সুরক্ষা দেয়। কারাবন্দী থাকা অবস্থায় পর্যাপ্ত খাদ্য, সুচিকিৎসা ও অন্যসব প্রয়োজন পূরণে রাষ্ট্রকে বাধ্য করে।

বর্তমানে অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ে প্রচলিত যে রিমান্ড পদ্ধতি এটাকেও ইসলাম নাকোচ করে। ইবনে হাজম রহ. বলেন,

'ব্যাক্তির অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য কোনও প্রকার নির্যাতন, বেত্রাঘাত, হুমকি প্রদান কিম্বা কেবল স্বীকার করাবার জন্য কারাবন্দী করা সম্পূর্ণরূপে না-জায়েজ।

কেননা কোরআন, সুন্নাহ ও ইজমার কোনও দলিলই এর বৈধতা দেয় না বরং কোরআন ও সুন্নাহ এর বিপক্ষে রায় দেয়।'

কোনও ব্যক্তির উপর জুলুম সংগঠিত হলে, অন্যায় শাস্তির স্বীকার হলে যেহেতু ইসলাম সেটাকে সামাজিক বিপর্যয় হিসেবে দেখে। ফলত এটা রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব কেউই যেন অন্যায়ভাবে দণ্ডিত না হয়।

ফলত ইসলামি ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিধি প্রত্যেক ব্যাক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের অবাধ অধিকার নিশ্চিত করে। কোনও অবস্থাতেই, কোনও অজুহাতেই সেই অধিকারের চর্চা থেকে কোনও ব্যক্তিকে নিবৃত্ত কিম্বা বঞ্চিত করা যাবে না।*

আধুনিক কমন ল' তে আত্মপক্ষ সমর্থনের ভিত্তি হচ্ছে আইনজীবী নিয়োগ। অবশ্যই আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু এই যে, ধর্ষকের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়াতে পারবে না বলে হাইপ তোলা হলো সেটা কিন্তু অবিচারের সংস্কৃতিকেই আরও পোক্ত করছে।

২।
আল্লাহ বলছেন,
'আপনার কাছে যে মহৎ ব্যবস্থা এসেছে, তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। আমি তোমাদের জন্য একটি আইন ও পথ দিয়েছি।' ৫:৪৮)

এই যে আইন ও বিচারপদ্ধতি সেই পদ্ধতির বাইরে যাওয়াকে আল্লাহ কোর'আনে অন্য এক জায়গায় বাড়াবাড়ি বলছেন। আর সমস্ত বাড়াবাড়িই জুলুম এবং অন্যায়। ফলত তা অবশ্য পরিত্যাজ্য।

'কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমরা তার প্রতিকারের অধিকার দিয়েছি কিন্তু সেই ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে।' (১৭:৩৩)

প্রতিকারের যে ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে, সেটা হলো বিচারিক পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে একটা ফেয়ার ট্রায়াল হবে, বাদী ও বিবাদী উভয়েই সমান আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে।

এর ব্যত্যয় হলে সেটাও হবে জুলুম এবং অপরাধ। আদতে এই আয়াতের দ্বারা এই মূলনীতি
প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলত ইসলামের দৃষ্টিতে সমস্ত বিচারবহির্ভূত হত্যা ভয়াবহ জুলুম, অবিচার।

কোনও এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং কখনোই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে না। এমনকি ব্যাক্তিটি যদি অপরাধীও হয় তবুও তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেওয়াটাই জুলুম।

সে অপরাধী হলে উপযুক্ত বিচারিক পদ্ধতিতেই সেই দণ্ড কার্যকর করতে হবে। এটাই ইনসাফ, আদল, ন্যায়বিচার। আমাদেরকে ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।

ধর্ষণ হলে আমরা ক্রসফায়ারের কথা বলি- বিচারবহির্ভূত হত্যার মত ভয়াবহ জুলুমের পক্ষে জনমত তৈরি করি। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে এইরকম বহু জুলুমের সুযোগ করে নিজেরাও সেই জুলুম ও খুনে অংশীদার হয়ে উঠলাম সে ব্যাপারে আমাদের ভাবনা কতখানি?

অপরাধীরও যে মানবাধিকার আছে, সেই ধারণা ইসলাম বহু আগে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে সভ্যতার যে মৌলিক দিক দুনিয়ার সামনে এনেছিল আজকে এত বছর পর আমরা এর বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম কেন?

ইসলাম যে চেতনা ধারণ করতে বলে, যে শক্তির বলে দুনিয়ায় শান্তির কথা বলে সেই ইনসাফ ও আদলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কি আমরা ইসলামেরই বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম না? আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।

মনে রাখতে হবে, একটা অন্যায় অপর অন্যায়ের স্বপক্ষে কোনও বৈধতা তৈরি করে না। যদি দুটো কাজই অন্যায় হয়, তবে দুটোই সমান ঘৃণ্য। অন্যায়ের বিপক্ষে কেবল ন্যায় প্রতিষ্ঠাই কল্যাণ আনতে পারে। বাকি সব অকল্যাণ।

আমাদের অবস্থান হোক কল্যাণের পক্ষে, যাবতীয় অকল্যাণের বিরুদ্ধে। ইসলাম আমাদের জন্য কল্যাণ নিয়ে এসেছে। ইসলামি শরীআর পূর্ণ বাস্তবায়ন একমাত্র সমাধান।
★ Al-Alwani, Shaybani Taha Jabir,issues in Contemporary Islamic Thought, 'The International Institute of Islamic thought ' 1426 AH
Next Post Previous Post